বিল দেন চেকে, ঘুষ নেন নগদে

ফয়সাল খান: বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের প্রকল্পের বিল তুলতে ঘুষ দিতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে। কমিশনের নামে নেওয়া এই ঘুষের টাকা নগদ না পাওয়া পর্যন্ত চেক ছাড় দেননি সংস্থাটির নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আখতারুজ্জামান। অথচ সৎ কর্মকর্তা হিসেবে চলতি বছরের জুনে তিনি পেয়েছেন শুদ্ধাচার পুরস্কার! এমন একজন ‘দুর্নীতিবাজ’ কর্মকর্তা শুদ্ধাচার পুরস্কার পাওয়ায় খোদ সংস্থাটির কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

 

ট্রাস্ট-সংশ্লিষ্ট কয়েক কর্মকর্তার দাবি, আখতারুজ্জামান সদ্য-বিদায়ি ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নুরুন নাহার হেনার আস্থাভাজন হওয়ায় সবকিছু জেনেও কিছু বলার সাহস পেত না কেউ। পরে এমডি পরিবর্তন হওয়ায় তার অপকর্ম নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন অনেকেই।

 

শুদ্ধাচার পুরস্কার পাওয়া আখতারুজ্জামানের অনিয়ম ও দেশের বিভিন্ন পৌরসভায় বাস্তবায়ন হওয়া কিছু প্রকল্পের তথ্য আসে প্রতিদিনের বাংলাদেশের হাতে। তথ্যগুলো যাচাই করতে পরিচয় গোপন রেখে ১০টি পৌরসভার প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেন এ প্রতিবেদক। তাদের সবাই জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের প্রকল্পের বিল নিতে কমিশন দেওয়ার কথা স্বীকার করেন।

 

এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি অডিও ক্লিপ প্রতিদিনের বাংলাদেশের হাতে রয়েছে। প্রকল্প পরিচালকদের ভাষ্য অনুযায়ী, কমিশনের পরিমাণ নির্দিষ্ট করা না থাকলেও ১ শতাংশের কম কেউ দেননি। কারও কাছ থেকে দুই-আড়াই শতাংশ হারেও কমিশন নেওয়া হয়েছে। তবে দেনদরবার করে বা পরিচিত লোক ধরে অনেকেই তুলনামূলক কম কমিশন দিয়ে বিল তুলেছেন।

 

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, প্রকল্পের বিলের চেক নিতে এলে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিতে হয়েছে হিসাব বিভাগে। ১০ প্রকল্প পরিচালকের মধ্যে ৭ জনই সরাসরি কমিশনে টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। বাকি তিনজনের একজন জানান, ‘ঠিকাদার বিষয়টি ড্রিল করেছেন।’ অপর দুজন জানান, তাদের স্পষ্ট মনে নেই। তবে বিল তুলতে টাকা দিতে হয়েছে। কমিশন সম্পর্কে জানতে চাইলে তাদের একজন জানান, ‘কমিশনের কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ নেই। যে যেমন দিয়ে নিতে পারে।’ মোটকথা বিল নিতে গেলে যে কমিশনের নামে ঘুষ দেওয়া লাগে সবাই তা অকপটে স্বীকার করেছেন।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের বেশিরভাগ প্রকল্পই দুই কোটি টাকার। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সৌরবাতি স্থাপন, জলাবদ্ধতা নিরসন, ড্রেন নির্মাণ ও ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট সংস্কার ও নির্মাণের জন্য এসব প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের অর্থ চার কিস্তিতে ভাগ করে দেওয়া হয়। প্রতি কিস্তিতে ৫০ লাখ টাকা করে চেক ইস্যু করা হয়। সেই চেক তোলার জন্য ১ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ নগদ কমিশন দিতে হয়। কমিশনের টাকা না পাওয়া পর্যন্ত চেক দেন না আখতারুজ্জামান। সর্বনিম্ন ১ শতাংশ ধরলেও প্রতি কিস্তি থেকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নেন তিনি। সে হিসাবে একটি প্রকল্পের চেক পেতে অন্তত দুই লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।

 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের একাধিক কর্মকর্তা জানান, কমিশন না দিলে চেক ইস্যু হতো না। বিষয়টি সবাই জানে, ‘ওপেন সিক্রেট’ বলা চলে। যেসব পৌরসভা বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে তারাও সবাই জানে। কিন্তু এমডি পরিবর্তন হওয়ায় সেই ‘ঘুষের সিন্ডিকেট’ দুর্বল হলেও পুরোপুরি নির্মূল হয়নি।

 

তারা জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের সদ্য সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হেনার আস্থাভাজন ছিলেন আখতারুজ্জামান। তিনি ট্রাস্টের সব প্রকল্প থেকে নেওয়া কমিশন তৎকালীন এমডির মাধ্যমে ভাগবাটোয়ারা করতেন। শীর্ষ অনেক কর্মকর্তাই এর ভাগ পেতেন। যার প্রতিদান হিসেবে আখতারুজ্জামানকে শুদ্ধাচার পুরস্কার দেওয়া হয়।

 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির সদ্য সাবেক এমডি নুরুন নাহার হেনা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, এগুলো আমার জানা নেই। শুদ্ধাচার পুরস্কার দেওয়া হয়েছে আমি যাওয়ার পর। সুতরাং কে পেল, কীভাবে পেল তা আমি বলতে পারব না।

 

বর্তমান এমডি মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, এখানে আসার পর নানা অনিয়ম, অসংগতি পেয়েছি। এগুলো দূর করার জন্য কাজ করছি। প্রকল্প পরিচালকদের ডেকে সভা করছি, যাতে কাউকে কোনো ধরনের অবৈধ সুবিধা না দেওয়া হয়। পাশাপাশি এই অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও সঙ্গে সঙ্গে ফাইল ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি।

 

শুদ্ধাচার পুরস্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি নতুন জয়েন করার সময় এটা দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে খোঁজ নেওয়ার সুযোগ ছিল না। প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। এখানে কোনো ব্যত্যয় হলে বা কেউ অনিয়ম করলে অবশ্যই বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো শুনে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আখতারুজ্জামান বলেন, এগুলো সঠিক নয়। যেখান থেকে শুনেছেন, ভুল শুনেছেন। সব কাজ এলজিইডি থেকে হয়। আমরা শুধু বিল দিই। এখানে আমাদের তেমন কিছু করার নেই।

 

নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রকল্পগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসন, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে সৌর বিদ্যুতের সড়ক বাতি ব্যবহারের মাধ্যমে কার্বন নির্গমন হ্রাস, ড্রেন নির্মাণ ও পরিবেশের উন্নয়ন ইত্যাদি।

 

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, প্রকল্পের টাকা জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের পর আরও অনেক ধাপে কমিশন দিতে হয়। এতে মূল কাজ সঠিকভাবে হয় না। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসব প্রকল্প নেওয়া হয়, মাঠ পর্যায়ে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় না।

 

অপর একটি সূত্রে জানা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট থেকে পৌর মেয়র বা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের প্রকল্পের প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রস্তাব দেওয়ার সময়ই কমিশনের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে যায়। মনমতো কমিশন দিতে রাজি হলেই প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। বেশিরভাগ সংস্থার প্রধানরাই কমিশন দিয়ে প্রকল্প নিতে রাজি হন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুজন প্রকৌশলী জানিয়েছেন, অনেক পৌরসভা তেমন উন্নয়ন বরাদ্দ পায় না। তাই কমিশন দিয়ে হলেও প্রকল্প নিতে রাজি হয়ে যান মেয়ররা।

 

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত ক্ষতি কমানো, সমস্যা মোকাবিলার জন্য উদ্ভাবনী গবেষণা, প্রযুক্তি উন্নয়ন ও উদ্ভাবনের জন্য সরকার ২০১০ সালে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে। ট্রাস্ট গঠনের পর থেকে ২০২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮৫১টি প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে সংস্থাটি, তাতে খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা। কর্মকতারা জানিয়েছেন, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ৩৭০টি প্রকল্প চলমান। সরকারের ১৫টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে দপ্তর ও সংস্থাগুলো এসব প্রকল্প নিয়ে থাকে। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানে তাদের প্রকল্প বেশি।

 

সূত্র- প্রতিদিনের বাংলাদেশ

©  2019-2024 All Rights Reserved. Design By Ghost